জীবনের ধন কিছুই যায় না || ফেলা দীপ্তি মৈত্র - কুঁড়েঘর
জীবনের
ধন কিছুই যায় না ফেলা
দীপ্তি
মৈত্র
আলো বাতাসহীন অন্ধকার ঘরেই পড়ে থাকে প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া বৃদ্ধা
মানুষটি। একদিন সকালবেলা হঠাৎ হৈ-চৈ এর শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অতনুর। শুনতে পায় বাবা রুদ্রের
চিৎকার- "এই পৌলমি শুনছো? দেখবে এসো তাড়াতাড়ি।"
পৌলমি (রাগত স্বরে) -"কি হলো কি, বাড়িতে ডাকাত পড়ার মতো চিৎকার
করছো কেন?"
রুদ্র (হাসতে হাসতে) - আরে দেখো না, হাতটা ধরো
পৌলমি (বিরক্ত ভাবে)- "ইস মাগো, কেনো মরতে আমি আবার ঐ বুড়িটার
হাত ধরতে যাবো?" (স্বামীর মুখের দিকে অবাক চেখে তাকিয়ে)"অ্যাই, সকাল সকাল
তোমার মাথা কী খারাপ হল? বলি আগের দিনের নেশার ঘোর কাটেনি নাকি? সকাল সকাল এত উৎপাত
করো কেন বলেতো?"
রুদ্র - (হাসতে হাসতে) হা!হা!হা! "আমি ঘোরে নেই গো। হঠাৎ কেমন
সন্দেহ হতে মায়ের হাতটা ধরে নাড়িটা দেখলুম। গেছে বুড়িটা।"
পৌলমি- "এই সত্যি বলছো? (উল্লাসিত হাসিতে ফেটে পড়ে) হা!হা!হা!
"এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি" যাও তাহলে দাহ কার্যটা তাড়াতাড়ি
সেরে আসো।"
রুদ্র (শান্ত ভাবে) -”আরে দাঁড়াও ডার্লিং। তোমার না সবেতে
তাড়াহুড়ু। ডাক্তারকে ডেকে আগে Death Certificate টা লেখাতে হবে না।দাঁড়াও আমি স্বপন
বাবুকে ফোন করে বলি”।
পৌলমি (আহ্লাদিত ভাবে, স্ত্রী ভক্ত স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে)-"অ্যাই
শোনোনা! ওই বুড়ির শ্রাদ্ধ শান্তির জন্য কি আবার টাকা পয়সা বেকার খরচ করবে?”
রুদ্র -“আরে পৌ একটা লোক চক্ষুর ব্যপার আছে
না? লোকে কি বলবে বলোতো?”
পৌ- “আরে তুমি কি ভুলে গেছো এই মাসের
18 তারিখ আমাদের সুইজারল্যান্ডের টিকিট কাটা আছে ! পাপনের (অতনুর ডাক নাম) স্কুলে গ্রীষ্মের
ছুটি পড়ছে যে। দূর তুমি না, ঢ্যাঁড়শ একটা সব ভুলে যাও।"
রুদ্র- (চেয়ারে বসে মাথাটা নীচু করে হাতের ওপর রেখে) তাহলে কি করি বলোতো
পৌ! ফ্ল্যাটের সব লোকজ...ন, হঠাৎ করে সিগারেট প্রেমিদের হারিয়ে যাওয়া দেশলাই খুঁজে
পাওয়ার মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল- গোয়ায়! গোয়ায়!
পৌলমি- (অবাক হয়ে) কি গেয়ায় গোয়ায় করছো? ও ও বুঝেছি লোক জনকে বলবে গোয়ায়
গিয়ে মায়ের অন্তিম কর্ম সেরে এসেছো? Right?
এইসব কথোপকথোন চলতে চলতেই স্বপন বাবু আসেন। তৎক্ষণাৎ অভাগী মায়ের পুত্র
ও পুত্রবধূর দুই জনের চেখে কুমীরের কান্না। ডাক্তার বাবু রেগীকে দেখে ডেথ সার্টিফিকেট
লিখে দিয়ে চলে যান।
টানাটানির সংসারে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর সময় মায়ের চোখ জ্বলজ্বল
করে উঠত স্বপ্নে-আধ পেটা খেয়েও মুখে ফুটতো হাসির ঝিলিক। দুই বুড়ো বুড়ি স্বপ্ন দেখতো
ছেলের সঙ্গে বিরাট বাড়িতে থাকবে থাকতে পেয়েছিল ঠিকই,কিন্তু 'মা' নয়, কর্মচারী হিসাবে।
শেষ জীবনে হয়তো পোষ্য কেউ। বৃদ্ধা মানুষটির স্বপ্ন ছিলো গাড়ি করে ছেলের সাথে সেজেগুজে
ঘুরতে যাবে। আজ সত্যি সে সেজেছে ফুলের মালায়, গাড়িতেও উঠেছে কিন্তু ’শব বাহী’। ঘুরতেও যাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে বহু দূরে'না
ফেরার দেশে'।
ক্রমে এলো বহু কাঙ্খিত সেই ১৮ তারিখ।স্বামী-স্ত্রী অতনুকে নিয়ে ঘুরতে
গেলেন সুইজারল্যান্ডে। হাসি, আনন্দ, হৈ -চৈ, সেল্ফির চক্করে সবাই ভুলেই গেলো মৃতা মানুষটির
আজ পিণ্ড দানের দিন। শুধু পাপনের বুকের কাছে একরাশ দুঃখ জমাট বেঁধেছি। ও বুঝতে পারতো
বাবাই -মা, ঠাম্মার ওপরে অন্যায় অত্যাচার কর। শিশু মন ভেতরে ভেতরে ছটফট করলেও প্রতিবাদ
করতে পারেনি।
এভাবে কেটে গেলো আরও কুড়ি বছর। অতনুর বিয়ে হল। ঘরে ছোট্ট মিষ্টি ফুটফুটে
নাতি এ। রুদ্রের চাকরি জীবন শেষ। এবার নাতিই তার খেলার সাথী।পৌলমি নাতিকে দেখে আহ্লাদে
ভরপুর হয়ে বলতে লাগলেন- "ওমা, কি সুন্দর দেখতে হয়েছে গো আমাদের মানিককে। এছো তো বাবা, দেকি একতু
আমার কোলে এছো তো। ”দু
হাত বাড়িয়ে নাতিকে কোলে নিতে যাবে এই সময় অতনু বলে-"না মা, আমার ছেলের গায়ে কোনো
বিষাক্ত মানুষের ছোঁয়া লাগবে না।এমনকি আমি এটাও চাইনা, তোমাদের স্বার্থপর নিঃশ্বাস
আমার সন্তানের কাছে আসুক। আজই তোমাদের সব জিনিস গুছিয়ে রেখো, আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমে
কথা বলে রেখেছি- কালই তোমাদের দিয়ে আস। মাসে মসে খরচা পাঠিয়ে দেবো।"
পৌলমি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলতে গিয়েছিল "কিন্তু কেনো বাবা
তু--ই"। কথা শেষ না হতে দিয়েই অতনু বিরক্ত কণ্ঠে বলল "কেন? তোমার বলতে
এত টুকু লজ্জা করলো না মা? নিজেরা নিজেদের বিবেক কে প্রশ্ন করো পেয়ে যাবে উত্তর। আর
, ব্যাগটা কিন্তু গুছিয়ে রেখো।” অতনু ঘরে ঢুকে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিল। পরের দিন রাতে
বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি দেয়াল যেন তাদেরকে বিদ্রুপ করতে লাগল।ভেসে এলো সেই মায়ের কণ্ঠস্বর-
"কিরে খোকা! মনে পড়ছে আজ থেকে বাইশ বছর আগেকার কথা??? মনে পড়ছে আমার সাথে
করে আসা সেই ব্যবহারগুলো?" কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগলো রুদ্রের কানে।
বৌমা! আমার মতো তোমারও নাতিকে কাছে পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো না মা?
No comments