শিরোনাম

রক্তের দামে কেনা
মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ

শাহনাজ ডালিম গাছের গোড়ায় বসে কাঁদছে।দুপুর বেলার সূর্য রশ্মি পাতার ফাঁক দিয়ে মুখাবয়বের মধ্যে এসে পড়ছে।
সে দিকে খেয়াল নেই।এক মনে কেঁদেই চলছেন।

৭১- এর ভয়ার্ত এক বেদনা তার বুকে দানা বেঁধেছিল তা আজও ভেসে ওঠছে।

সে এক করুণ ইতিহাস।
ভুলতে পারেন না। ক্ষণিক কেঁদে নিজেকে হালকা করেন।

আরিফ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। সে ক্লাস এইটে পড়ে। মাকে এমনভাবে হঠাৎ কাঁদতে দেখে জানতে চায়,মা কাঁদছো কেন? তোমার কি হয়েছে?
---- শাহনাজ মুখকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়।আস্তে করে চোখ  মুছে কান্নাকে গোপন করতে চেষ্টা করে।কিন্তু পারে না।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দু' ফোটা অশ্রু ললাট বেয়ে নিচে পড়ে যায়।

--- আরিফ জড়িয়ে ধরে মাকে।হাত দিয়ে অশ্রু মুছে দেয় ।আলতো করে কপালে চুমু খায়।আবার জানতে চায়, মা কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার?

--- ছেলের এ সোহাগ মিশ্রিত কন্ঠে মার কান্না আরো বেড়ে যায়।কোন কথাই কন্ঠ চিড়ে বের হয় না।
----- মার চোখে পানি দেখে আরিফের চোখেও পানি এসে যায়।
--- বলো মা,বলো? তোমার কি হয়েছে? নইলে আমিও উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলবো?

---- ছেলের দিকে চেয়ে মা বলতে শুরু করে,

--- বাবা আরিফ!তোমার বাবা এই দিনে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে।তুমি তখন দুধের ছেলে। যুদ্ধে যাবার সময় বলে গেছে,আমি যদি যুদ্ধের ময়দান থেকে আর না ফিরি তবে আমার এই ছেলেকে তুমি নিজ হাতে লেখা পড়া
শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে।আমার মন বলছে আমি বুঝি যুদ্ধের ময়দান থেকে আর ফিরবো না।নয়ন ভরিয়া ছেলেকে একটু দেখে নেই।

সত্যি তোমার বাবা সেদিন যুদ্ধে মারা যায়।
আর ঘরে ফিরেনি।
স্বামীকে হারিয়ে আমার মনে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা আজও শুকাইনি। ২৬শে মার্চের এই দিনটি এলেই আমার হৃদয়ের
ক্ষত ভেসে ওঠে। না কেঁদে পারিনে বাছা!
তবে বাবা ,লেখা- পড়া করে মানুষ হও।

তোমার বাবাসহ আরো যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনেছে সে স্বাধীনতা কে টিকিয়ে রাখতে হলে তোমাকে লেখা- পড়া করে বড় হতে হবে।তোমাকে শপথ নিতে হবে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার  জন্য।

---- আরিফ বলে ওঠে,
মা কেন দেশ স্বাধীন করতে হবে? আমাদের এদেশ কি তবে স্বাধীন ছিলো না?

--- মা সোহাগ মিশ্রিত কন্ঠে জবাব দেয়,
আরে অবুঝ! দেশ স্বাধীন থাকলে কি আর  এক  সাগর রক্ত ঝরতো দেশের
স্বাধীনতার জন্য।১৯৫৭সালে  ২৩শে জুন
এক ষড়যন্ত্রমুলক যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।এর পর  প্রায় দু,শ বছরের মতো ইংরেজ শাসনে বাঙালীর ভাগ্যোন্নয়ন হয়নি।তারপর ১৯৪৭সালে নাম মাত্র ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেও বাঙালীর জীবনে স্বাধীনতা আসেনি।

মুলত ২৪ বছর বাংলাদেশকে পাকিস্তানীরা তাদের উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহার করেছে।

---- আরিফের প্রশ্ন মা তারপর?
----- তারপর ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদা দেয়ার দাবীতে প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তা ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন দমননীতির ফলে বাঙালীর মনে ক্রমেই অসন্তোষ প্রবল হতে থাকে এবং অধিকার আদায়ের প্রেরণা জাগে।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কালো রাতের আক্রমণের পরিমাণ সারা বাংলাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা  ঘোষণা করা হয়।

সুশিক্ষিত পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
সেনাবাহিনী নিরস্ত্র, ঘুমন্ত লোকদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করে এবং অগণিত ঘর - বাড়ি পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। এই অবস্থায় সামরিক বাহিনী,বাঙালী লোকজন,আধা সামরিক লোক, ছাত্র- ছাত্রী,রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী মিলে মুক্তিবাহিনী গঠন করে এবং মুক্তি সংগ্রামে নেমে পড়ে।

দীর্ঘ ন' মাস যুদ্ধ হয়।ত্রিশ লাখ লোক প্রাণ হারায়।স্বাধীনতা অর্জিত হয়।রক্তের দামেই কেনা এ স্বাধীনতা।
সে সময়ই তোমার বাবা যুদ্ধে মারা যায়।

--- মার মুখে স্বাধীনতার এ নির্মম ইতিহাস শুনে আরিফের গা শিহরে  ওঠে।তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বর্তমান  দেশের চিত্র।

কয়েকদিন আগে থেকে তার এক ক্লাসমেট বন্ধুকে তার মা- বাবা খুঁজে
পাচ্ছে না। ছেলে ধরা একটি দল পাচারের জন্য তাকে ধরে নিয়ে গেছে।

--- মা তাহলে এতো কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা রইলো  কই? একটি ছেলে ,স্বাধীনভাবে লেখা- পড়া করার সুযোগ পাবে না? প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে?নিরাপত্তার কোন বালাই নেই? লাখ লাখ লোকের রক্ত কি বৃথা গেলো?

---- মায়ের জবাব,আরে বাছা!এজন্যই তো তোমাকে লেখা- পড়া করার  শপথ নিতে
হবে।যাতে দেশের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে পারো।

--- অবশ্যই মা।
প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। তোমার হাত ছুঁয়ে শপথ করছি।
তোমার চোখের পানি মুছে দেবো।বাবার মনের আশা পূরণ করবো।আমার জন্য দোয়া করো মা।দোয়া করো।দেখবে এদেশের  প্রতিটি মানুষের মনে হাসি ফুটাবো। মায়ের দোয়া আল্লাহ ফেরত দেন না। তাড়াতাড়ি কবুল করেন।

---- শাহনাজ বেগম কান্না ভেজা চোখে পড়নের কাপড়ের আঁচল প্রভূর দরবারে
তুলে ধরে ছেলের জন্য দোয়া মাগে।

No comments